একজন মুক্তিযোদ্ধা দাদুর গল্প। লেখক মনি হায়দার। Akjon Muktijoddar golpo
মুক্তিযুদ্ধের কিশোর গল্প
লেখক: মনি হায়দার
গল্পের নাম: একজন মুক্তিযোদ্ধা দাদুর গল্প
বাবা অফিস থেকে এসে জানালেন দাদু, মানে বাবার বাবা আসছেন, খুব শীঘ্রই। দাদু থাকেন গ্রামে। শহর একদম ভালো লাগে না তার। ঢাকায় এসে দু'চারদিন থাকার পর নাক সিঁটকিয়ে বলেন, শহর একটা থাকার জায়গা হলো? গাছপালা নেই, মাঠ নেই, নদী নেই। বাড়ির গেট বন্ধ থাকে চব্বিশ ঘণ্টা, খাঁচায় বন্দী মানুষ।
বুঝলি কাজল, আমার দম বন্ধ হয়ে আসে।
![]() |
১৯৭১ সালের স্বাধীনতা সংগ্রাম ও বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী একজন মুক্তিযোদ্ধার কাল্পনিক গল্প |
বাবা মা চেষ্টা করেন নানাভাবে, যাতে দাদুভাই ঢাকায় থাকেন। কিন্তু ঐ যে, কয়েকদিন থাকার পর দাদু কেমন হাঁপিয়ে ওঠেন। ঢাকায় যে ক'জন আত্মীয়-স্বজন আছে- বড় ফুফু, ছোট চাচা তাদের বাসায়ও দু'একদিন থাকার ব্যবস্থা করেন বাবা। যাতে দাদুর মনে জমে যাওয়া হাঁপটা চলে যায়। বাবা প্রতি ছুটির দিন দাদুকে নিয়ে ঢাকার দর্শনীয় স্থান দেখাতে নিয়ে যান এবং অনিবার্যভাবে আমি সঙ্গী হই।
না, কোনো কিছুতেই দাদুর ভিতরে জমে থাকা দুঃসহ মেঘ উড়ে যায় না। হয়তো একদিন, দুইদিন মোটামুটি ভালো থাকেন, তারপর আবার গ্রামের বাড়ি যাবার জন্য তোড়জোড় আরম্ভ করেন। বাবা নানা প্রকার বাহানা করেন।
কিন্তু দাদু একসময় রেগে যান বাবার উপর- কিরে জামান, আমি বাড়ি যাবো না? আমার লঞ্চের টিকেট কোথায়?
বাড়িতে গিয়ে আপনি কী করবেন? বাবা জানতে চান।
কি করবো সেটা আমার ব্যাপার। আমি তোদের ঢাকা শহরে আর একদিনও থাকবো না। যদি আমাকে টিকেট না এনে দিস, আমি পিরোজপুরে হেঁটেই রওয়ানা করব। দাদুভাই খুব রেগে গেছেন।
কি আর করা! বাবা বাধ্য হয়ে লঞ্চের টিকেট আনেন দাদুর জন্য। দাদু চলে যান। সবার আগে আমাকে পরীক্ষার পর যেতে বলেন। দাদু গ্রামের বাড়িতে একা থাকেন। দাদীভাই বেঁচে নেই। প্রায় সাত বছর আগে মারা গেছেন। দূর সম্পর্কের এক আত্মীয়া দাদুর দেখাশুনা করেন। সেজন্যই বাবা-মা চান দাদু আমাদের সঙ্গে ঢাকায় থাকুন। কিন্তু দাদুভাইয়ের ঢাকা শহর একদমই ভালো লাগে না। যদিও কোনো কারণে চার পাঁচ মাস পর ঢাকায় আসেন, তাহলে টেনেটুনে, রাগটাগ করে সাতদিনের বেশি রাখা যায় না।
আরও পড়ুনঃ মুক্তিযুদ্ধের কিশোর গল্প "পরীরানী"। লেখক মনি হায়দার
বাবা আরও জানালেন দাদুভাই আসছেন ঢাকায় তার অসুস্থতার কারণে। দাদু অসুস্থ? না, দাদুকে আমরা কখনও অসুস্থ দেখিনি। শক্ত সামর্থ্য শরীর। প্রতিদিন সকালে হাঁটেন। পানি খান সারাদিনে প্রায় পনের গ্লাস। দাদু যখন ঢাকায় এসে থাকেন, পাখি ডাকা ভোরে হাঁটতে বের হন, আমাকে সঙ্গে নেন। প্রথম প্রথম আমার বিছানা থেকে উঠতে ইচ্ছে হতো না। দাদুর তাড়নায় শেষ পর্যন্ত উঠতে হয়। ওমা! সকালে, পাখি ডাকা ভোরে ঘুম থেকে উঠতে দারুণ মজা তো। গাঢ় কুয়াশার কেমন আস্তরণ। চারপাশটা শান্ত স্নিগ্ধ। খুব ভালো লাগে আমার। এখন আর দাদুকে ডাকতে হয় না, আমিই বিছানা থেকে উঠে যাই। যখন দাদু ঢাকায় থাকেন না আমি আমাদের ছাদে, লনে হাঁটি। দাদুকে চিঠি লিখে আমি জানিয়েছি। ফেরত চিঠিতে তিনি আমাকে অনেক অনেক প্রশংসা করে চিঠি লিখেছেন। আর বরাবরের মতো পরীক্ষা শেষে গ্রামে বেড়াতে যাবার আকুল আমন্ত্রণ রেখেছেন। পরীক্ষার আর মাস দুয়েক বাকি। বাবার সঙ্গে আমার ইতিমধ্যে বোঝাপড়া হয়েছে, পরীক্ষার পরপরই আমরা স্বপরিবারে গ্রামে, পিরোজপুরে, কচানদীর পাড়ে, মায়াঢাকা গ্রাম বোথলায় বেড়াতে যাচ্ছি।
সেই বেড়াতে যাবার আগে দাদু আসছেন, শুনে খুব ভালো লেগেছিল। ঢাকায় বসে দাদুর সঙ্গে বসে বসে প্লান করা যাবে, আমরা গ্রামে গিয়ে কী কী করবো? আমার অনেকদিনের শখ, কচানদীর ওপারে, বিশাল একটা চর জেগেছে। ঐ চরটা দেখতে চাই। কী আছে চরটায়? এপারে দাঁড়িয়ে দেখা যায় অজস্র সাদা বকের উড়াউড়ি, নাচানাচি। অন্যপারের লোকেরা গরু-মহিষ চড়াতে আসে চরটায়। এপারের লোকজন যেতে পারে না গরু-মহিষ নিয়ে। অনেক দূর, অনেক গভীরতা আর সাঁই সাঁই ভয়ংকর স্রোত। দাদুকে এবার বলবো আমার প্লানটার কথা।
এই সময়ে বাবা আবার বললেন, তোমার দাদু অসুস্থ। মনটাই খারাপ হয়ে গেলো। কী হতে পারে দাদুর? জ্বর, কাশি, পেটে ব্যথা? দূর ছাই কী যে করি। আচ্ছা বাবা, অতো দুশ্চিন্তার কী আছে, নিজেকে সান্ত্বনা দেই। দাদু তো তিন দিন পরই আসছেন, তখন তার কাছে সব জেনে নেয়া যাবে। এখন সমস্যা হলো এই তিনটা দিন কোনোভাবে কাটছে না। তিনটা দিনকে কেউ বুঝি পেরেক মেরে দেয়ালে গেঁথে রেখেছে। নট নড়ন চড়ন। স্কুল, গানের ক্লাস, কোনোকিছুই আমার ভালো লাগে না। কী অসুখ হয়েছে দাদুর? দাদু হাঁটতে পারেন তো? অনেক যাতনায় তিনটি দিন-সঙ্গে তিনটা রাত পার হলো। দাদু তার অমায়িক মুগ্ধ হাসি সঙ্গে নিয়ে উপস্থিত। গ্রাম থেকে কলা, নারকেল, হাঁস, মুরগি, আমড়া আরও অনেক কিছু নিয়ে এসেছেন। দাদু, বাবা-মা হাসছেন, কথা বলছেন। দাদু আমাকে বুকে জড়িয়ে আদর করলেন। বললেন, তোমাকে নিয়ে বিকেলে শিশু পার্কে যাবো।
আরও পড়ুনঃ মুক্তিযুদ্ধের কিশোর গল্প "রহস্যময় মানুষ"
'আচ্ছা'- আমি সায় দেই।
কে বলে দাদু অসুস্থ! অসুস্থ মানুষ আমি চিনি না? আমার নানাকে দেখেছি না। নানাভাই প্রায়ই অসুস্থ থাকতেন। উঠতে পারতেন না। না পারতেন বসতে। প্রায় সারাক্ষণ বিছানায় শুয়ে থাকতেন। খেতেন নরম খাবার, পথ্য। অথচ দাদু একদম আগের মতো হাঁটছেন, বসছেন। কথায় কথায় হাসির ফুলকি ছুটোচ্ছেন? এমন প্রাণ খুলে যিনি হাসেন, তিনি অসুস্থ হন কীভাবে? আমার মাথায় কিছু ঢুকছে না। তাহলে বাবা কি আমার সঙ্গে মিথ্যা বললেন?
অসম্ভব।
বাবা মিথ্যাকে খুবই ঘৃণা করেন। তিনি আমাকে মিথ্যা বলবেন কেনো? বিকেলে দাদুর সঙ্গে শিশু পার্কে গেলাম। আমাকে সঙ্গে নিয়ে দাদু হেলিকপ্টারে চড়লেন, রেলগাড়িতে ঘুরলেন, আরও কত কি করলেন।
শেষে দাদা-নাতী দুটো ইয়া বড় সাইজের আইসক্রীম নিয়ে পার্কের এক পাশে, সবুজ ঘাসে বসে পড়লাম। আমার যে কী হাসি পাচ্ছে। দাদুর আইসক্রীম গলে গলে তার লম্বা দাড়িতে লাগছে। এক হাতে দাড়ি মুচছেন, অন্য হাতে আইসক্রীম খাচ্ছেন। দাদুর কাণ্ডকারখানা দেখে পার্কে আসা দু' একজন হাসছে। আইসক্রীম খাওয়া শেষে আমি দাদুকে জিজ্ঞেস করলাম, দাদু, আপনি নাকি অসুস্থ?
কে বললো?
বাবা।
হ্যাঁ, সামান্য অসুস্থ।
সেই অসুখটা কী?
আমার ডান পাশের কোমরে ব্যথা। অনেক আগে থেকেই ব্যথাটা আছে। মাসখানেক হলো ব্যথাটা বেড়েছে। বড় কষ্ট পাই।
ডাক্তারের কাছে কখন যাবেন?
তোর বাবা তো পারলে আমাকে এখনই ডাক্তারের কাছে নেয়। আমি বলি, আসছি ঢাকা শহরে, দু'দিন বেড়াই। তারপর ধীরেসুস্থে ডাক্তারের কাছে যাওয়া যাবে। কী বলিস?
কিন্তু, ব্যথাটা?
ব্যথাটা আমার ভালোই লাগে, খারাপ লাগে না। একটু বাড়ছে, এই যা।
ব্যথা মানুষের ভালো লাগে। আশ্চর্য! আমি আর একটা কথাও বললাম না। কী বললে আবার কী শুনতে হবে কে জানে? শরীরে ব্যথা নাকি ভালো লাগে! খেলতে গিয়ে সামান্য কেটে বা ছিড়ে গেলে যন্ত্রণায় টিকতে পারি না, আর আমার দাদু বলছেন- ব্যথাটা আমার ভালোই লাগে!
সকালে আমার স্কুলে যাওয়ার আগে দাদু ডাক্তারের কাছে গেছেন। সঙ্গে বাবা। দুপুরে স্কুল থেকে এসে দেখি দাদু গম্ভীর মুখে বসে আছেন।
আমাকে দেখে বললেন- দাদু, আমি বিকেলের লঞ্চে চলে যাচ্ছি।
কোথায়? আমি হতবাক!
কোথায় আবার, গ্রামে বোথলায়।
চিকিৎসা করাবেন না?
দাদু হাসলেন। বললেন- ডাক্তারেরা যে চিকিৎসা দিতে চায়, সেটা
আমি নেবো না।
আমি কিছু বুঝতে পারছি না দাদু।
আরও পড়ুনঃ বুক রিভিউ: "রাসুলের চোখে দুনিয়া"
শোন, ডাক্তারেরা আমার কোমরটাকে বেশ কয়েকটা এক্স-রে করে বললো- কোমরের ডানপাশে শক্ত একটা কিছু আছে। ওটা খুব খারাপ একটা দিকে চলে যাচ্ছে। অপারেশন করে ফেলে দিতে হবে। আমি বললাম- আমি অপারেশন করাবো না এবং শক্ত জিনিসটাও ফেলবো না। আমি ডাক্তারকে কিছু না বলে চলে এসেছি। বাসায় কিছুক্ষণ পর
তোর বাবা এসে খুব রাগ দেখালো আমার উপর। তোর বাবাকেও আমি বলেছি- আমি অপারেশন করাবো না।
কেনো দাদু? শক্ত ওটা কি?
ওটা? দাদু অমৃতসমান হাসি টানলেন মুখে, বললেন, ওটা গুলি দাদু।
গুলি?
হ্যাঁ।
কিসের?
একাত্তরের। স্বাধীনতা যুদ্ধে এই গুলি শরীরে নিয়েই দেশকে পেয়েছি।
দাদু, আপনি মুক্তিযোদ্ধা?
দাদু অনাবিল আনন্দে আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন। জীবনে আমি অনেক আদর পেয়েছি, কিন্তু দাদুর আজকের আদরের মতো এমন সুরেলা গর্বিত আদর আর কখনও পাই নি।