মুক্তিযুদ্ধের কিশোর গল্প "আনিস সাহেবের হাসি"। মনি হায়দার। Choto golpo Anis Saheber Hasi
মুক্তিযুদ্ধের কিশোর গল্প
লেখক: মনি হায়দার
গল্পের নাম: আনিস সাহেবের হাসি
আনিস সাহেব হাসছেন। অবশ্য তার এই হাসি কেউ দেখতে পাচ্ছে না। মনে মনে হাসছেন। নির্মল আনন্দের হাসি। এ হাসি সাহস আর কষ্টের। এই হাসির মধ্যে উল্লাস ও কান্না পাশাপাশি বসে আছে। উল্লাসের হাসি থেকে কান্নার হাসি আলাদা নয়।
বিকেল এখন।
আর কিছুক্ষণ পর সন্ধ্যা নামবে। রাস্তার আলোগুলো জ্বলে উঠেছে। আনিসুল হক বসে আছেন বারান্দায়। টানা লম্বা বারান্দা। তাঁর হাতে একটি বই। আজকাল তিনি সারাদিন বই পড়ে সময় কাটান। আবু কায়সারের 'রায়হানের রাজহাঁস' উপন্যাসটি তাঁর খুব প্রিয়। অনেকবার পড়েছেন। কিন্তু পুরনো হয় না। আবার পড়ছেন। পড়তে পড়তে দেখছেন তাঁর নাতি কাঁকন, কাঁকনের সঙ্গী আপেল, পায়রা, নিশাল-সবাই মিলে খুব ছোটাছুটি করছে। কখনও বারান্দায়, কখনও ড্রয়িং রুমে, কখনও ছাদে ধুপধাপ পা ফেলে, দৌড়ে এদের আনাগোনা। হাসি আর কোলাহল। খুব ব্যস্ত ওরা।
![]() |
মুক্তিযুদ্ধের কিশোর গল্প "আনিস সাহেবের হাসি"লেখক মনি হায়দার |
সবাই মিলে ওরা পতাকা তৈরি করছে। কাল ছাব্বিশে মার্চ। দূরে মাইকে বঙ্গবন্ধুর সাতই মার্চের বজ্রকণ্ঠ বাজছে- 'আর যদি একটা গুলি চলে, আর যদি আমার লোককে হত্যা করা হয়...।' আনিসুল হক বইটা বুজিয়ে পাশে রাখলেন। তিনি গাঢ় শ্যাম বর্ণ আকাশের গায় দৃষ্টি রাখলেন। আহ কী পরম শান্তি। তার সন্তানেরা আজ নিঃসংকোচে আনন্দে পতাকা উড়াতে পারছে। অথচ আজ থেকে ত্রিশ বছর আগে এই পতাকা, শেখ মুজিবের ছবি বাসায় রাখা ছিল ভয়ঙ্কর বিপজ্জনক। সেই ভয়ঙ্কর কষ্টকর ঘটনা এদেশের কচি শিশুরা জানে না।
আরও পড়ুনঃ একজন মুক্তিযোদ্ধা দাদুর গল্প। লেখক মনি হায়দার
একাত্তরে চাকরি উপলক্ষে... আনিসুল হক খুলনায় স্বপরিবারে থাকতেন। একজন বাঙ্গালী হিসেবে এদেশের গণমানুষের অধিকার আদায়ের সকল আন্দোলনে সকল সময়ে যোগ দিতেন। তার বারো বছরের ছেলে সোলেমান বাড়ির সামনে দিয়ে যেসব মিছিল যেত, সে মিছিলে সোলেমান যোগ দিতই। কোনোভাবে একে আটকে রাখা যেত না। 'জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু' স্লোগানে মুখরিত রাজপথের মিছিলে সোলেমান থাকবে না, ভাবাই যায় না। বাসায় এসে সোলেমান বাংলাদেশের মানচিত্র তৈরি করত আর 'আঁকত শেখ মুজিবের ছবি। শেখ মুজিবের অনেক আকারের, অঙ্গভঙ্গির ছবি 'আঁকত সোলেমান। সময় নেই অসময় নেই-সোলেমান ছাদে উঠে পতাকা উড়িয়ে দিত।
বাড়িঅলা একদিন এসে সোলেমানকে খুব বকল:
জানো তুমি কতবড় অন্যায় করছ?
সোলেমান হাসির দৃষ্টিতে নির্বাক তাকিয়ে থাকে বাড়িঅলার দিকে। আনিসুল হক বুঝতে পারেন না, তার ছেলে কি অন্যায় করেছে, যার জন্য ভরদুপুরে বাড়িঅলা কোমর দোলাতে দোলাতে, ঘামে জবজবা শরীরে ড্রয়িং রুমে ঢুকে হম্বিতম্বি করছে?
কী করেছে সলু? জানতে চান সোলেমান সলুর বাবা আনিসুল হক।
কী করে নাই সেইটা বলুন- গিঁট খুলে যাওয়া লুঙ্গি সামলাতে সামলাতে বলে বাড়িঅলা। বাজার কইরা রিকশায় বাসায় আসতেছি। বাসার কাছাকাছি আইস্যা ছাদের দিকে চাইয়া তো আমার ফিট পড়ার যোগাড়-
বাড়িঅলা এই পর্যন্ত বললেই হেসে ফেলে সোলেমান। হাসার কী কথা কইলাম- যে তুমি হাসতেছ?
সোলেমান মুখ নিচু করে হাসতে থাকে। বেশ ফাঁপরে পড়েন আনিসুল হক। ছাদে বাড়িঅলা কী দেখে ফিট খেতে চায়? আবার সে কথা শুনে হাসছে কেন সোলেমান।
আরে সাহেব-
কি দেখে আপনি অজ্ঞান হতে চেয়েছেন?
বেঢপ কুৎসিত লোমশ ভুঁড়ি দোলাতে দোলাতে আনিসুল হকের সামনে এগিয়ে যায় বাড়িঅলা- পতাকা।
পতাকা?
হ। আমার বাড়ির ছাদের চাঁদতারা পতাকার পরিবর্তে জয়বাংলার পতাকা উড়তাছে- আমার ইজ্জত, ইমাম সব শেষ হয়ে গেল। জলদি, জলদি আপনার পোলারে কন- জয়বাংলার পতাকা নামাতে।
আরও পড়ুনঃ মুক্তিযুদ্ধের কিশোর গল্প "পরীরানী"। লেখক মনি হায়দার
এতক্ষণে আনিস সাহেব পুরো ব্যাপারটা বুঝতে পারলেন। তিনি জানেন, বাড়িঅলা ভদ্রলোক সাতচল্লিশের সময়ে ওপার থেকে এসে খুলনায় জায়গা নিয়েছিল। এখনও সে মনেপ্রাণে বাঙালি হতে পারে নি। জীবন-জীবিকা ধারণ করে এ দেশে জায়গা-জমি বাড়ি করে দিব্যি আরামে আছে- তারপরও সে প্রায় বারো শ' মাইল দূরের দেশে তার ইমান, দেশপ্রেম বন্ধক রেখেছে। খুব রাগ হয় আনিস সাহেবের।
আনিস সাহেবকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে মেজাজ চড়িয়ে বাড়িঅলা জিজ্ঞেস করে- আপনি কি চান- আমার ইমান নষ্ট হোক?
পতাকার সঙ্গে ইমানের কী সম্পর্ক? পাল্টা প্রশ্ন করেন আনিসুল হক। হায় হায় আপনি কন কী? বাড়িঅলা তার হোঁতকা শরীর নিয়ে ধপাস শব্দে সোফায় বসে- এইডা আপনে কী কইলেন? চাঁদতারা হলো আসমানের ব্যাপার- মুসলমানের চিহ্ন। আর জয়বাংলার পতাকা অইলে হিন্দুগো চিহ্ন।
জয়বাংলার পতাকা হিন্দুদের চিহ্ন কে বলল আপনাকে?
আনিস সাহেবের মুখের দিকে বেশ কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বাড়িঅলা উঠে দাঁড়ায়। কঠিন চোখে তাকায় আনিস আর সোলেমানের দিকে। লুঙ্গি সামলাতে সামলাতে সে ড্রয়িং রুমের মধ্যে পায়চারি করতে থাকে। নাক দিয়ে ঘোঁৎ ঘোঁৎ শব্দ বেরুচ্ছে বাড়িঅলার। হঠাৎ পায়চারি থামিয়ে দাঁড়ায় আনিসুল হকের সামনে, মুখোমুখি, একেবারে গাঁ ঘেঁষে।
আপনে প্রায় পাঁচ বছর আমার বাসায় ভাড়া রইছেন- দিলে একটা মহব্বত পয়দা অইছে। সে কারণে খারাপ দিকে যাব না। আপনি আগামী মাসে আমার বাসা ছেড়ে দেবেন- এইটা আমার শেষ কথা।
বাড়িঅলা হন হন করে দরজার কাছে যায়। হঠাৎ থমকে দাঁড়ায়। আবার ফিরে আসে আনিসুল হকের কাছে। বাড়ি না ছাড়লে কপালে দুঃখ আছে আপনার ফ্যামিলির। বাড়িঅলা আর দাঁড়ায় না, দ্রুত চলে যায়। আনিসুল হক এবং তার বারো বছরের পুত্র সোলেমান হতবাক। বিমর্ষ মুখে সোফায় বসে আনিস। ফেব্রুয়ারি মাস শেষ হতে বাকি মাত্র সাত দিন। এই সাত দিনে নতুন বাড়ি কি পাওয়া যাবে? তাছাড়া বাড়ি ছাড়ার কোন মানসিক প্রস্তুতিও ছিল না। সোলেমানের মায়ের শরীর খারাপ। সোলেমান নিজেকে অপরাধী ভাবে। তার জন্য হঠাৎ এই বিপদ এসে উপস্থিত। সোলেমান বাবার কাছে আসে। বসে পাশে।
বাবা, আমি পতাকা উড়াব না, ফুঁপিয়ে ওঠে সে। ছেলের মাথায় অভয়ারণ্যের হাত রাখেন আনিসুল হক হাসেন কেন পতাকা উড়াবি না? অবশ্যই উড়াবি। এ বাড়ি না হয়, অন্য বাড়ি। পতাকা আমাদের উড়াতেই হবে।
বাবা?
হ্যাঁ, সোলেমান। এইসব অশুভ শক্তির কাছে হেরে গেলে তো চলবে না। এদেশ আমাদের।
আমাদের শক্ত হতে হবে-
পিতা এবং পুত্রের মঝে ট্রে হাতে ঢোকেন সোলেমানের মা জয়নাব বেগম কই?
কে?
বাড়িঅলা- আনিস সাহেবের উত্তরে বলেন জয়নাব বেগম-বাড়িঅলাকে দেখে আমি চা তৈরি করতে গিয়েছিলাম।
আরও পড়ুনঃ মুক্তিযুদ্ধের কিশোর গল্প "রহস্যময় মানুষ"
নাই, বাড়িঅলা চলে গেছে।
কেন? চা খেয়ে যেতে বললে না?
আনিস সাহেব স্ত্রীর কথার কোনো উত্তর না দিয়ে নিচে নেমে গেলেন যত তাড়তাড়ি সম্ভব নতুন বাড়ি খুঁজে বের করার জন্য।
সোলেমানের বাবা আনিসুল হক দু'টি সন্তান, স্ত্রী, বৃদ্ধ মা ও কাজের লোকসহ নিজেকে নিয়ে মোট ছয়জনের থাকার মতো একটি বাসা খুঁজে বের করতে পারেন নি মাত্র সাত দিনের মধ্যে। বাধ্য হয়ে সোলেমানের মা, বোন, দাদি ও কাজের লোককে গ্রামের বাড়ি পিরোজপুরের বোথলা গ্রামে পাঠিয়ে দেন আনিসুল হক। একটি এক রুমের ছোট বাসা নিয়ে থেকে যান তিনি এবং সোলেমান। আগামী মাসে সোলেমানের পরীক্ষা। সোলেমানের পরীক্ষাটা হয়ে গেলে আস্তে-ধীরে একটা ভালো বাসা খুঁজে বের করবেন এবং বাড়ি থেকে সবাইকে আনাবেন- এই রকম একটা পরিকল্পনা পিতা ও পুত্রের। এই বাসায় শেখ মুজিবের ছবি বা জয়বাংলার পতাকা উড়াতে কোনো সমস্যা হচ্ছে না সোলেমানের। সে রাত জেগে, কিংবা পড়ার ফাঁকে ফাঁকে বাসায় বসে পতাকা তৈরি করে। যদিও একই কক্ষে বাপের সঙ্গে থাকতে একটু কষ্টই হচ্ছে, তবুও সে ছবি আঁকতে পারায়, জয়বাংলার পতাকা বানানোর সুযোগ পাওয়ায় সে সামান্য কষ্ট মনে রাখে না।
ফেব্রুয়ারি চলে গেল। এলো মার্চ মাস। চারপাশটা কেমন বদলে যাচ্ছে- পিতা ও পুত্র দু'জনেই দেখতে পাচ্ছে মিছিল, মিটিং, স্লোগানে খুলনার পথঘাট পূর্ণ। এমন কোন দিন নেই যেদিন এসব হচ্ছে না। মিছিলে সবার হাতে জয়বাংলার পতাকা, শেখ মুজিবের ছবি। সোলেমানও মিশে যায় মিছিলে। মিছিলে গেলে সোলেমান অসংখ্য সোলেমানে রূপান্তরিত হয়ে যায়। কোথেকে যে বুকে অথৈ সাহস আসে- সে বুঝতে পারে না। মিছিলের লোকগুলোকে সে হয়তো কখনও দেখেনি- কিন্তু তাতে কিছু যায় আসে না। সবাইকে সে আপন মনে করে। পরিচিতজন।
মিছিল থেকে বাসায় ফিরলে বাবা জিজ্ঞেস করেন- খোকা, আজকের মিছিলটা কত বড় ছিল?
অনেক বড়।
মিছিলে তোর ভয় করে না?
ওমা! কেন?
না, মানে মিছিলের লোকগুলো অপরিচিত-
হাসে সোলেমান কে বলল অপরিচিত? মিছিলের প্রত্যেকটি
মানুষকে আমি চিনি। ওরাও আমাকে চেনে।
তাই নাকি?
হ্যাঁ বাবা।
ছেলের সাহসে আনিসুল হক আরও সাহসী হন। তারও মিছিলে যেতে খুব ইচ্ছে করে। কিন্তু তিনি সরকারি চাকরি করেন- গেলে বিপদ হবে।
মার্চের পঁচিশ তারিখ, দিন শেষে রাতে পাকিস্তানিরা তাদের দীর্ঘদিনের অপেক্ষার আস্তিনে গুটিয়ে রাখা মরণকামড় নিয়ে বাঙালীর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। প্রথমে ঢাকায়, পরে দেশের অন্যান্য শহরেও। খুলনা শহরেও পকিস্তানীর শকুনেরা ক্ষুধা নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে। প্রথম দুই দিন দুই রাত শহরে ইলেকট্রিসিটি ছিল না।
কারফিউ। ঘরের বাইরে বার হতে বারণ। দিনে রাতে বিকালে দুপুরে সকালে আজানের সময় মাঝরাতে শেষ রাতে কেবল শোনা যেত গুলির শব্দ, মানুষের আর্তনাদ আর গাড়ির চাকার বিশ্রী কর্কশ আওয়াজ। সোলেমান, তার বাবা আনিসুল হক ঘরের মধ্যে দমছাড়া পুতুলের মতো পড়ে থেকেছিল দুই দিন, দুই রাত। দুই দিন দুই রাত পর কারফিউ তুলে নিলে আনিস সাহেব ছেলে সেলেমানকে সঙ্গে নিয়ে খুলনা শহরের পাঁচ মাইল দূরে গোবরডাঙ্গা গ্রামে অফিসের কলিগের বাড়ি আশ্রয় নেন। দিন শেষে সন্ধ্যার দিকে হঠাৎ তার মনে হয়- তিনি সরকারি কর্মচারী। চাকরি করেন খুলনা বেতারে। তিনি বেতার প্রকৌশলী। যদি কর্তৃপক্ষ তাকে খুঁজতে বাসায় আসে। আর যদি পেয়ে যায় ওরা শেখ মুজিবের অসংখ্য ছবি, জয়বাংলার পতাকা... আনিসুল হক ভাবতে ভাবতেই সিদ্ধান্ত নেন, আজ রাতে আবার বাসায় ফিরে যাবেন এবং ওসব ধ্বংস করে আবার ফিরে আসবেন এখানে। সোলেমানকে সে কথা বলতেই সোলেমান গোঁ ধরে আনিস সাহেবের সঙ্গে আসবে।
আরও পড়ুনঃ অতিসংক্ষিপ্ত প্রশ্নাবলি: জোটবদ্ধ রাজনীতি ও আন্তঃদলীয় সম্পর্ক
অনেক বোঝানোর চেষ্টা করে ছেলেকে, কিন্তু ছেলের এক কথা-আমি কোনো কথা শুনব না- তোমার সঙ্গে যাব। কি আর করা, অন্ধকার রাত, মেঘলা আকাশ, ইলশেগুঁড়ি বৃষ্টি মাথায় নিয়ে অচেনা পথে যাত্রা করেন পিতা এবং পুত্র। বিলের মধ্য দিয়ে নৌকায় কিছুটা পথ এসে, হাঁটু সমান পানিতে নেমে হাঁটতে হাঁটতে আধমরা হয়ে, খানাখন্দক পার হয়ে, সোলেমানের পা কেটে রক্ত ঝরিয়ে রাত বারোটার সময় খুলনা শহরের উপকণ্ঠে পৌছান।
পাকিস্তানি মিলিটারীর তীব্র হুইসেল, ছুটে চলা জিপ বা ট্রাক লরির ভয়ঙ্কর আলোর গা বাঁচিয়ে আনিসুল হক ছেলে সোলেমানকে সঙ্গে নিয়ে
চোরের কায়দায় রাত তিনটে নাগাদ বাসায় পৌঁছান। হাসেন আপনমনে, দুঃখে, মোচড় খাওয়া যাতনায়, নিজেদের দেশে, নিজেদের শহরে তিনি, তাঁর সন্তান আজ চোর। বাসায় পৌছে দিয়াশলাইয়ের কাঠি জ্বালিয়ে বিছানার নিচে, পড়ার টেবিলে, এখানে সেখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা শেখ মুজিবের ছবি, জয়বাংলার পতাকাগুলো বাথরুমে জড়ো করে জ্বালিয়ে দিলেন। যাতে ধোঁয়া বাইরে না যেতে পারে, সেজন্য আনিস সাহেব বাথরুমের একমাত্র ছোট্ট ফাঁকটা কাগজ সেঁটে বন্ধ করলেন। ধোঁয়ায় বাথরুমটি আচ্ছন্ন। চোখের সামনে পুড়ে যেতে দেখছেন আনিসুল হক, প্রিয় পুত্রের হাতে আঁকা শেখ মুজিবের অসংখ্য ছবি, জয়বাংলার অজস্র পতাকা। বদ্ধ ধোঁয়ায় ঘরটা ভরে গেছে। বুকের পাঁজর ভেঙ্গে দমকে দমকে কাশি আসছে। কাশি সামলাতে সামলাতে তিনি তাকান সোলেমানের দিকে। সোলেমানের দুই চোখে পানি, নীরবে নামছে গাল বেয়ে। আনিসুল হক বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরলেন ছেলেকে। সোলেমান হাউমাউ করে কেঁদে ফেলল। আনিস সাহেব দেখলেন মহাবিপদ। রাতের অন্ধকারে কান্নার শব্দ রাস্তায় টহলরত পাকিস্তানি মিলিটারির কানে যেতে পারে।
ছেলেকে বুকের সঙ্গে জাপটে ধীরে ধীরে, সন্তর্পণে ঘরের দরজায় তালা লাগিয়ে আবার ফিরতি পথে গোবরডাঙ্গা যাত্রা করেন। পথে নামার সঙ্গে সঙ্গে ইলশেগুঁড়ি বৃষ্টি মুষলধারে নামতে থাকে।
আনিস সাহেব ভাবেন- ভালোই হলো, মুষলধারে বৃষ্টির কারণে মিলিটারির টহল কমবে। সত্যিই তাই। বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে পিতা এবং পুত্র গোবরডাঙ্গায় পৌঁছান সকালের দিকে। আর পৌছেই সোলেমানের শরীর কাঁপিয়ে জ্বর আসে। সোলেমান জ্বরের মধ্যে প্রলাপ বকতে আরম্ভ করে- বাবা, আমার জয়বাংলার পতাকা, আমার শেখ মুজিবের ছবি। যমে-মানুষের টানাটানির পরে সোলেমান সুস্থ হয়ে ওঠে প্রায় পনেরো দিন পর। দিনগুলো ছিল অসহ্য কষ্টের, যন্ত্রণার, আতংকের। সোলেমান জ্বরে তড়পায়, তার মা বহুদূরে, গ্রামে। ডাক্তার পাওয়া যায় না। সোলেমান বাঁচবে কি না সন্দেহ ছিল। সেই সোলেমানের ছেলে কাঁকন, তার নাতি, নাতির বন্ধুরা নিশ্চিত নিরাপত্তায়, স্বাধীনতার গর্বে অনাবিল আনন্দে জয়বাংলার পতাকা তৈরি করছে। শেখ মুজিবের ছবি আঁকছে। একের পর এক।
আরও পড়ুনঃ বুক রিভিউ: "রাসুলের চোখে দুনিয়া"
পতাকা তৈরি এবং শেখ মুজিবের ছবি আঁকা থেকে এসব সন্তানদের কেউ কখনও ফেরাতে পারবে না। বিরত রাখতে পারবে না। সে কারণেই আনিস সাহেবের বুকের মধ্যে হাজার হাজার পায়রা একসঙ্গে নাচতে থাকে, নাচতে থাকে, নাচতে থাকে। আর তিনি হাসেন, আনন্দের হাসি, তৃপ্তির হাসি, অকুতোভয়ের হাসি।